লাভ-লোকসান যা-ই হোক, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে কর দিতে হবে। সেই টার্নওভার ট্যাক্স বা লেনদেন করহার এত দিন ছিল শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। আগামী অর্থবছর থেকে সেটি বাড়িয়ে ১ শতাংশে উন্নীত করেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। ব্যবসায়ীরা বলছেন, লেনদেন কর বৃদ্ধির কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের ওপর আর্থিক চাপ বাড়বে। বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, লেনদেন করের কারণে কোম্পানির লোকসানের পাল্লা ভারী হবে। তাতে অনেক ছোট ব্যবসায়ী ব্যবসা থেকে ছিটকে যেতে পারেন। এনবিআর রাজস্ব বাড়াতে লেনদেন কর বৃদ্ধির মতো অমানবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার বদলে অটোমেশন চালু ও তদারকি বাড়ানো দরকার। তাহলেই রাজস্ব আদায় বাড়বে সরকারের। এফএম প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহম্মদ গাজী তৌহিদুর রহমান বলেন, ‘লেনদেন কর বাড়ানো উচিত হয়নি। এতে লোকসান করলে কোম্পানিগুলোর বিপদ বাড়বে। শুধু তাই নয়, আমাদের কাছ থেকে পণ্য নিয়ে যেসব ব্যবসায়ী কম মুনাফায় ব্যবসা করেন, তাঁরা ভয়াবহ সমস্যায় পড়বেন। কারণ তাঁদের মুনাফার তুলনায় লেনদেন বেশি হয়। এ ধরনের ব্যবসায়ীদের জন্য লেনদেন কর একটা বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।’ আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ লেনদেন কর বর্তমানের চেয়ে দশমিক ৪ শতাংশ বাড়িয়ে ১ শতাংশ করার ঘোষণা দেন। মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ও অন্যান্য করের বাইরে সরকার এ ১ শতাংশ অর্থ নেবে আয়কর হিসেবে। বছর শেষে কোম্পানি যদি লোকসানে থাকে, তাহলেও এই কর দিতে হবে। যদিও তা সমন্বয়ের সুযোগ রাখা হয়েছে। ধরা যাক, দেশের কোনো একটি কোম্পানি ১০০ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেছে। তাহলে তাকে লেনদেন কর দিতে হবে ১ কোটি টাকা; কিন্তু বছর শেষে দেখা গেল পণ্য বিক্রি করে কোম্পানিটি ১০ কোটি টাকা লোকসান করেছে। তাহলে তার ওপর কোনো করপোরেট কর বা আয়কর প্রযোজ্য হবে না। তবু তার কাছ থেকে সরকার ১ কোটি টাকা নেবে, যেটিকে লেনদেন কর বলা হলেও তা মূলত করপোরেট কর। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লোকসানে থাকা কোম্পানির ওপর লেনদেন কর বেশি প্রভাব ফেলবে। যারা অনেক টাকা মুনাফা করে, তাদের ওপর এটি তেমন একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। কারণ, তাদের লেনদেন করের চেয়ে বছর শেষে আয়করের পরিমাণ বেশি হয়। ফলে তারা লেনদেন কর বাবদ দেওয়া টাকা বাদ দিয়ে বাকি টাকা সরকারকে দিতে পারবে। ফ্যাশন হাউস উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্যাশন উদ্যোক্তা সমিতির (এফইএবি) সভাপতি আজহারুল হক আজাদ বলেন, ছোট-মাঝারি ফ্যাশন হাউসগুলো কোন রকমে ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হওয়ার পর তারা লাভের জায়গায় নেই। এমন প্রেক্ষাপটে লেনদেন কর বৃদ্ধির কারণে প্রতিষ্ঠানের লোকসানের পাল্লা ভারী হবে। চলতি মূলধনের ঘাটতিতে পড়বে অনেকে। তখন খরচ কমানোর দিকে হাঁটবে কোম্পানিগুলো। ফলে কর্মী ছাঁটাই বাড়বে। দুঃখজনক হচ্ছে, এ বিষয়গুলো সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বুঝছেন না। দেশে অনেক দিন ধরেই লেনদেন কর রয়েছে। বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরাও দীর্ঘদিন ধরে এই কর বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। প্রস্তাবিত বাজেটে টেলিযোগাযোগ খাতের কোম্পানির ক্ষেত্রে এই কর ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে দেড় শতাংশ করা হয়েছে। অন্যদিকে তামাক ও তামাকজাত পণ্যের উৎপাদক ও বিক্রেতা এবং কোমল পানীয় উৎপাদনকারীদের ওপর আগের মতোই ৩ শতাংশ রাখা হয়েছে। জানতে চাইলে কেপিসি এন্টারপ্রাইজের চেয়ারম্যান কাজী সাজেদুর রহমান বলেন, যেসব কোম্পানি নিরীক্ষা প্রতিবেদনে চুরি করে তাদের ধরতে লেনদেন কর বাড়ানো হয়েছে। তবে তার দায় কেন ছোটদের ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে। লেনদেন কর বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি অমানবিক। বছর শেষে যখন একসঙ্গে অনেক টাকা দিতে হবে, তখন চলতি মূলধনের ঘাটতিতে পড়ে যাবে অনেক ছোট কোম্পানি। বাড়তি করের বোঝার কারণে অনেকে ব্যবসা থেকে ঝরে পড়তে পারে। লেনদেন করের বিষয়ে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রাহমান প্রথম আলোকে বলেন, লেনদেন কর বাড়ানো কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত হয়নি। এতে ব্যবসার খরচ বেড়ে যাবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) যখন রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে না তখন বিভিন্ন জায়গায় করহার বাড়িয়ে দেয়। অথচ অটোমেশন চালু ও করজাল বাড়িয়ে রাজস্ব আদায় বাড়ানো সম্ভব। অথচ এনবিআর সেই পথে হাঁটছে না। ছোট ব্যবসায়ীদের টিকিয়ে রাখার স্বার্থে লেনদেন কর বৃদ্ধির বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। Source: প্রথম আলো