২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সরকার আয়করের ক্ষেত্রে ১২টি এসআরও (স্ট্যাচুটোরি রেগুলেটরি অর্ডারস) বাতিল করেছে। এসব এসআরও-এর মাধ্যমে বিভিন্ন খাতে কর ছাড় বা কর অব্যাহতির সুবিধা দেওয়া হতো। এবার এসব সুবিধা বাতিল করে রাজস্ব আহরণ বাড়ানো এবং কর ব্যবস্থাকে আরও স্বচ্ছ ও কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার (১০ জুন) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, গত ২ জুন বাতিলকৃত এসআরওগুলোর মধ্যে রয়েছে— কৃষি, মৎস্য, সঞ্চয়পত্র, দানশীল প্রতিষ্ঠান, জ্বালানি খাতসহ বিভিন্ন খাতের কর ছাড়। দীর্ঘদিন ধরে এসব সুবিধার অপব্যবহার ও রাজস্ব ক্ষতির কারণে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পদক্ষেপের পেছনে রয়েছে আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা আইএমএফের চাপ এবং দেশের আর্থিক ব্যবস্থার টেকসই উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা। কর ছাড়ের সুযোগ বন্ধ করে সরকার বাজেট ঘাটতি কমাতে চাইছে।
সরকারি কর নীতি বিশ্লেষকদের মতে, এসআরও বাতিলের ফলে রাজস্ব আয় বাড়বে এবং কর ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আসবে। তবে কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ওপর এর প্রভাব কেমন হবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে।
রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জানিয়েছে, আগামীতে কর সংগ্রহে আরও আধুনিকায়ন ও কঠোরতা আনা হবে, যাতে কর প্রদায়নের হার বৃদ্ধি পায়।
বিশ্লেষকদের মতে, এই পদক্ষেপ দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে এবং বাজেটের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়তা করবে।
নিচে ১২ এসআরও এবং তার মূল সুবিধাসমূহ ও বাতিলের কারণ সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:
১. এসআরও-৩৩/২০০৯ (৯ মার্চ ২০০৯)
সুবিধা: তিনটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে (বঙ্গবন্ধু ট্রাস্ট, আরসিএইচ, এসএফডি হাসপাতাল) দান করমুক্ত।
বাতিলের কারণ: বিতর্কিত ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা।
২. এসআরও-৩৯৩/২০১৩ (২ জানুয়ারি ২০১৩)
সুবিধা: ‘ঢাকা স্কুল অব ইকোনোমিকস ফাউন্ডেশন’-এ দান করমুক্ত।
বাতিলের কারণ: জনহিতকর দানের অপব্যবহার ও কর ফাঁকির অভিযোগ।
৩. এসআরও-১৯৯/২০১৫ (১ জুলাই ২০১৫)
সুবিধা: এই এসআরও অনুযায়ী, পেলেটেড পোল্ট্রি ফিড (খোসা ছাড়ানো হাঁস-মুরগির খাবার) উৎপাদন, গবাদি পশু, চিংড়ি ও মাছের পেলেটেড ফিড উৎপাদন, বীজ উৎপাদন, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বীজ বিপণন, গবাদি পশুর খামার, দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যের খামার, ব্যাঙ উৎপাদন খামার, উদ্যান (হর্টিকালচার) খামার প্রকল্প, তুঁত গাছের চাষ, মৌমাছির চাষ প্রকল্প, রেশম গুটিপোকা পালনের খামার, ছত্রাক (মাশরুম) উৎপাদন খামার, ফুল ও লতাপাতার চাষ হতে অর্জিত আয়ের উপর আয়কর হ্রাস করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে প্রথম ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ৩ শতাংশ, পরবর্তী ২০ লাখ টাকার উপর ১০ শতাংশ ও অবশিষ্ট আয়ের উপর ১৫ শতাংশ কর নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। ১ জুলাই ২০১৫ থেকে সর্বশেষ ২০২৪-২৫ করবর্ষ পর্যন্ত এই এসআরও সুবিধা বহাল ছিলো।
বাতিল কারণ: দীর্ঘমেয়াদে বহাল থাকায় রাজস্ব ক্ষতি; নিয়ন্ত্রণহীন ছাড়।
৪. এসআরও-২৫৫/২০১৫(১৮ আগস্ট ২০১৫)
সুবিধা: এই এসআরও অনুযায়ী, হাঁস-মুরগি, চিংড়ি ও মাছের হ্যাচারি এবং মৎস্য চাষ হতে অর্জিত আয়ের উপর কর হ্রাস করা হয়। এর মধ্যে এসব খাত থেকে প্রথম ১০ লাখ পর্যন্ত আয়ের উপর কর শূন্য বা অব্যাহতি দেওয়া হয়। পরবর্তী ১০ লাখ টাকা আয়ের উপর ৫ শতাংশ ও অবশিষ্ট আয়ের উপর ১০ শতাংশ হারে কর নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। ১ জুলাই ২০১৫ থেকে এই কর ছাড় সুবিধা দেওয়া হয়। তবে মৎস্য, হ্যাচারি, পোল্ট্রিসহ বেশ কয়েকটি খাতে আয়ের ক্ষেত্রে করছাড় সুবিধার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠে। এছাড়া এসব খাতে কালো টাকা সাদা করার প্রমাণও পায় এনবিআর।
বাতিলের কারণ: কালো টাকা সাদা করার অভিযোগ, অপব্যবহার, এনবিআরের আপত্তি।
৫. এসআরও-১৩২/২০১৮ (১৩ মে ২০১৮)
সুবিধা: প্রাকৃতিক গ্যাসে কর অব্যাহতি।
বাতিলের কারণ: জ্বালানি খাতে রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর প্রয়াস।
৬. এসআরও-২৭/২০১৯ (৩১ জানুয়ারি ২০১৯)
সুবিধা: ‘গফুর মরিয়ম সাত্তার সাকেরা ফাউন্ডেশন’-এ দান করমুক্ত।
বাতিলেল কারণ: জনহিতকর খাতে কর ছাড়ের সুনির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণ না থাকায় অপব্যবহার।
৭. এসআরও-১৫৭/২০২২ (১ জুন ২০২২)
সুবিধা: এই এসআরও অনুযায়ী, হাঁস-মুরগির খামার, হাঁস-মুরগি, চিংড়ি ও মাছের হ্যাচারি এবং মৎস্য চাষ হতে অর্জিত আয়ের উপর কর হ্রাস করা হয়েছে। এর মধ্যে এসব খাত থেকে আয়ের প্রথম ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত কর শূন্য। পরবর্তী ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের উপর ৫ শতাংশ, পরবর্তী ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের উপর ১০ শতাংশ ও অবশিষ্ট আয়ের উপর ১৫ শতাংশ হারে কর নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাতিলের কারণ: আগের ছাড়ের পুনরাবৃত্তি ও অপব্যবহারের আশঙ্কা।
৮. এসআরও-২৫৩/২০২৩ (২৩ আগস্ট ২০২৩)
সুবিধা: এই এসআরও অনুযায়ী, সঞ্চয়ী আমানত ও স্থায়ী আমানত ইত্যাদি হতে অর্জিত সুদ বা মুনাফা; সঞ্চয়পত্র হতে অর্জিত মুনাফা এবং রপ্তানির বিপরীত প্রাপ্ত নগদ ভর্তুকি হতে আয় হতে উৎসে কর্তিত করের পরিমাণকে চূড়ান্ত করদায় হিসেবে নির্ধারণ করে এসব আয়ের বিপরীতে অতিরিক্ত কোনো করদায় পরিশোধ হতে অব্যাহতি প্রদান করা হয়। এর মধ্যে সঞ্চয়ী আমানত ও স্থায়ী আমানত ইত্যাদি হতে অর্জিত সুদ বা মুনাফা কেবল রিটার্ন দাখিল হতে অব্যাহতিপ্রাপ্ত করদাতারা এই সুযোগ পাবেন। আর সঞ্চয়পত্র হতে অর্জিত মুনাফা সকল স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতা ও রপ্তানির বিপরীতে প্রাপ্ত নগদ ভর্তুকি সকল করদাতারা এই সুযোগ নিতে পারবেন।
বাতিলের কারণ: উচ্চ আয়ের করদাতাদের করফাঁকির সুযোগ।
৯. এসআরও-২৮৬/২০২৩ (১১ অক্টোবর ২০২৩)
সুবিধা: এই এসআরও অনুযায়ী, সম্পত্তি হস্তান্তর হতে অর্জিত মূলধনি আয়ের ক্ষেত্রে উৎসে কর্তিত করের পরিমাণকে চূড়ান্ত করদায় হিসবে নির্ধারণ করে এর উপর অর্জিত আয়ের বিপরীতে অতিরিক্ত কোনো করদায় পরিশোধ হতে অব্যাহতি প্রদান করা হয়। সকল স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতা এই সুবিধা নিতে পারবেন।
বাতিলের কারণ: চূড়ান্ত করদায়ের ছত্রছায়ায় মূলধনি আয়ের কর ফাঁকি।
১০. এসআরও-৩৮২/২০২৪ (৩ নভেম্বর ২০২৪)
সুবিধা: সিদ্ধ ও নন-সিদ্ধ চাল আমদানিতে কর অব্যাহতি।
বাতিলের কারণ: আমদানি ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় স্থানীয় কৃষকের ক্ষতি।
১১. এসআরও-৩৮৩/২০২৪ (৪ নভেম্বর ২০২৪)
সুবিধা: এই এসআরও অনুযায়ী, আয়কর আইনের ৩৪১ ধারার ক্ষমতাবলে আইনের সপ্তম তফসিল (বিশেষ করহার) সংশোধন করা হয়। অর্থাৎ বিশেষ করহার সাধারণত অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। আদেশ অনুযায়ী, ‘মূলধনি আয়’ হিসেবে পরিগণিত হয়-এমন আয়ের ক্ষেত্রে করহার নির্ধারণ করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে কোম্পানি, তহবিল ও ট্রাস্ট কর্তৃক অর্জিত মূলধনি আয়ের উপর ১৫ শতাংশ; কোম্পানি, তহবিল ও ট্রাস্ট ব্যতীত অন্যান্য করদাতাদের স্টক এক্সচেঞ্জ তালিকাভুক্ত কোম্পানির সিকিউরিটিজ লেনদেন হতে অর্জিত মূলধনি আয়ের উপর ১৫ শতাংশ করহার নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া কোম্পানি, তহবিল ও ট্রাস্ট ব্যতীত অন্যান্য করদাতাদের, স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সিকিউরিটিজ লেনদেন হতে অর্জিত মূলধনি আয় ব্যতীত, অন্যান্য আয়ের ক্ষেত্রে-যেইক্ষেত্রে মূলধনি পরিসম্পদ অর্জন বা প্রাপ্তির অনধিক ৫ বছরের মধ্যে পরিসম্পদ হস্তান্তর হয়, সেইক্ষেত্রে এই রূপ মূলধনি আয় মোট আয়ের অন্তর্ভুক্ত হবে এবং মোট আয়ের উপর নিয়মিত করহার হবে। যেইক্ষেত্রে মূলধনি পরিসম্পদ অর্জন বা প্রাপ্তির পাঁচ বছর অতিক্রম হবার পর পরিসম্পদ হস্তান্তর হয়, সেইক্ষেত্রে এইরূপ মূলধনি আয়ের ১৫ শতাংশ কর হবে। ১ জুলাই ২০২৫ আরদ্ধ করবর্ষ হতে এই আদেশ কার্যকর হবার কথা ছিলো, যা বাতিল করা হয়েছে।
বাতিলের কারণ: অপ্রদর্শিত আয়ের বৈধতা প্রদান নিয়ে সমালোচনা।
১২. এসআরও-৮২-আইন/২০২৫ (১২ মার্চ ২০২৫)
সুবিধা: এই এসআরও অনুযায়ী, শুকনা ও তাজা ফলের উৎসে কর ১০ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ৫ শতাংশ করা হয়। ফলের মধ্যে রয়েছে-তাজা বা শুকনা কমলা লেবু, লেবু, লেবু জাতীয় ফল, আঙ্গুর, তাজা আপেল ও নাশপাতি।
প্রসঙ্গত, এই ১২টি এসআরও বাতিলের মাধ্যমে কৃষি, পোলট্রি, মৎস্য, জনহিতকর দান, সঞ্চয়পত্রের মুনাফা, সম্পত্তি হস্তান্তর, ও গ্যাস আমদানির করছাড় বন্ধ হলো। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ এবং রাজস্ব ঘাটতি কমানো ও স্বচ্ছতা বাড়ানো এই সিদ্ধান্তের মূল কারণ।