একনজরে বাজেটে আয়কর সংক্রান্ত যতসব পরিবর্তন আসছে? কর অব্যাহতি পাচ্ছে আইসিটি, শর্ত ক্যাশলেস

আগামী বাজেটে আয়কর সংক্রান্ত বেশকিছু পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কিছু ক্ষেত্রে কর হার কমানো হলেও ব্যক্তি শ্রেণির আয়করের সর্বোচ্চ হার বাড়ানো, শর্তযুক্ত সেবার সংখ্যা বাড়ানো, কিছু ক্ষেত্রে উৎসে কর বাড়ানোসহ আরও কিছু প্রস্তাব দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

ব্যক্তি শ্রেণির কর হার:

গত অর্থবছরের মতো এবারও বার্ষিক সাড়ে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত শূন্য শতাংশ কর আরোপ হবে। পরবর্তী ১ লাখ টাকা বৃদ্ধিতে ৫ শতাংশ কর দিতে হবে। এরপরের ৪ লাখ বৃদ্ধিতে আরও ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ১০ শতাংশ কর ও ৫ লাখ টাকার ওপরে হলে ১৫ শতাংশ কর আরোপ হবে। এরপরের ৫ লাখ টাকার জন্য কর দিতে হবে ২০ শতাংশ। এগুলো অর্থবছরের সঙ্গে মিল রেখে করা হলেও, এ অর্থবছরের ব্যক্তি করের ক্ষেত্রে আরও একটি ধাপ/স্ল্যাব যোগ করা হয়েছে। এবার ২০ লাখ টাকার বেশি আয়ের ক্ষেত্রে এ স্ল্যাব যুক্ত হবে। এক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ কর আরোপ করা হবে। অবশিষ্ট টাকার ওপর করের সর্বোচ্চ হার ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রথমবারের মতো ব্যক্তি পর্যায়ের পাশাপাশি কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান কোনো রকম প্রশ্ন ছাড়াই কালো টাকা সাদা করতে পারবে। তাও আবার ১৫ শতাংশ হারে কর পরিশোধ করলেই বৈধতা নেওয়া যাবে। অর্থাৎ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যে কোনো প্ল্যাটফর্মে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে আগামী প্রস্তাবিত বাজেটে। বিগত দিনে কালো টাকা সাদার করার যত সুযোগ দেওয়া হয়, তা মূলত ব্যক্তি হিসেবে সুযোগ গ্রহণ করতে পারতো বলে জানা গেছে।

পরিসংখ্যান বিবেচনা করলে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থ বছরে সর্বাধিক ২০ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা সরাসরি বিনিয়োগের মাধ্যমে বৈধ করা হয়েছিল। ওই অর্থবছরেও ৯৮ শতাংশ করদাতা বিভিন্ন আমানত, এফডিআর, সঞ্চয়পত্র বা নগদ টাকার ওপর ১০ শতাংশ কর দিয়ে ঘোষণার মাধ্যমে সাদা বা বৈধ করার সুযোগ নিয়েছেন।

৪ বছর বিরতির পর সাধারণ ক্ষমার আওতায় আগামী অর্থবছরে ফেরত আসতে পারে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার করার সুযোগ। ১৫ শতাংশ কর পরিশোধ করে যে কেউ কালো টাকা টাকা সাদা করার সুযোগ পাবে, আগামী বাজেটে এমন বিধান যুক্ত করার প্রস্তাবনা থাকছে। অ্যামনেস্টি বা সাধারণ ক্ষমাসহ এ সুযোগ দেওয়ার ফলে অর্থের বিষয়ে কোনো সংস্থা প্রশ্ন করতে পারবে না।

কর্পোরেট কর হার:

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির করপোরেট কর কমতে পারে আড়াই শতাংশ। আগে এ কর ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ থাকলেও, এবার তা ২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে ৫ শতাংশ বাড়বে সমবায় সমিতির করপোরেট কর।

উৎসে কর ১০ শতাংশ বাড়তে পারে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকে জমানো টাকার মুনাফায়। তবে ঋণপত্রের মাধ্যমে ও ঠিকাদারি হিসেবে খাদ্যপণ্য সরবরাহে উৎসে কর কমে অর্ধেক হবে।
 
এছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উৎসে কর কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। যা বাজারে স্বস্তি ফেরাতে পারে। ধান, চাল, গম, আলু, মাছ, মাংস, পিঁয়াজ, রসুন, মটর, ছোলা, মসুর, আদা, হলুদ, শুকনা মরিচ, ডাল, ভূট্টা, আটা, ময়দা, লবণ, ভোজ্যতেল, চিনি ইত্যাদি সরবরাহের ক্ষেত্রে উৎসে কর ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে ফল ও ফুল আমদানির ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ কর বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে। 

আইটি খাতের কর অব্যাহতি:

হাইটেক পার্ক, গভীর সমুদ্র বন্দরসহ আরও কয়েকটি খাতে কর অব্যাহতির সুবিধা আর নাও থাকতে পারে। তবে আইটি খাতের কর অব্যাহতি সুবিধার সময়সীমা বাড়িয়ে, তালিকাভুক্ত সেবার সংখ্যা কমতে পারে। এসব তালিকাভুক্ত খাতের কর অব্যাহতি আরও ৩ বছর রাখার প্রস্তাব করেছে এনবিআর।কর অব্যাহতি পাচ্ছে আইসিটির ১৯ উপখাত, শর্ত ক্যাশলেস লেনদেন।কর অব্যাহতির তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ব্লকচেইন, রোবটিক্স, সফটওয়্যার-অ্যাজ-এ-সার্ভিস (স্যাস) ও ডেটা সায়েন্স। তবে কর অব্যাহতির সুবিধা থেকে বাদ পড়ছে ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন), সিস্টেম ইন্ট্রিগ্রেশন ও ক্লাউড সার্ভিস।

যে ১৯টি উপখাত নতুন বাজেটে কর অব্যাহতির সুবিধা পাচ্ছে সেগুলো হলো— এআই-বেজড সল্যুশন ডেভেলপমেন্ট; ব্লকচেইন-বেজড সল্যুশন ডেভেলপমেন্ট; রোবোটিক্স প্রসেস আউটসোর্সিং; সফটওয়্যার-অ্যাজ-আ-সার্ভিস; সাইবার সিকিউরিটি সার্ভিস; ডিজিটাল ডেটা অ্যানালিটিক্স ও ডেটা সায়েন্স; মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস; সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ও কাস্টমাইজেশন, সফটওয়্যার টেস্ট ল্যাব সার্ভিস; ওয়েব লিস্টিং, ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট ও সার্ভিস; জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিস; ডিজিটাল অ্যানিমেশন ডেভেলপমেন্ট; ডিজিটাল গ্রাফিক্স ডিজাইন; ডিজিটাল ডেটা এন্ট্রি ও প্রসেসিং; ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম ও ই-পাব্লিকেশন; আইসিটি ফ্রিল্যান্সিং; কল সেন্টার সার্ভিস; এবং ডকুমেন্ট কনভারশন, ইমেজিং ও ডিজিটাল আর্কাইভিং।

কর অব্যাহতির সুবিধা পাওয়া আগের ও নতুন তালিকা বিশ্লেষণ  জানা গেছে, কর অব্যাহতির তালিকায় একেবারেই নতুন করে যুক্ত হয়েছে এআই, ব্লকচেইন, রোবটিক্স, সফটওয়্যার-অ্যাজ-আ-সার্ভিস ও ডেটা সায়েন্স। কর অব্যাহতির তালিকা থেকে বাদ পড়েছে এনটিটিএন, সিস্টেম ইন্ট্রিগ্রেশন ও ক্লাউড সার্ভিস।

বর্তমানে আইসিটি খাতের ২৭টি উপখাত কর অব্যাহতির সুবিধা পেয়ে আসছে। তবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ১৯ খাতে এই সুবিধা থাকছে। ২০১১ সাল থেকে আইটি সেবার ওপর কর অব্যাহতি দিয়ে আসছে এনবিআর। তিন থেকে পাঁচ বছর করে এই কর অব্যাহতির মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। ৩০ জুন এই অব্যাহতির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল।

বর্তমানে ৪৩ সেবায় রিটার্ন বাধ্যতামূলক সহ আরও তিন ক্ষেত্রে যুক্ত রিটার্ন জমার প্রমাণ:


এছাড়া শর্তযুক্ত সেবার সংখ্যা বাড়িয়েছে এনবিআর। বিয়ের জন্য কমিউনিটি সেন্টার ভাড়াসহ তিন ক্ষেত্রে রিটার্ন জমার প্রমাণ দেখানো বাধ্যতামূলক হতে পারে বলে জানা গেছে। কমিউনিটি সেন্টার ও মিলনায়তন ভাড়া করার ক্ষেত্রে কিছু শর্ত দেওয়া হতে পারে । যেমন কোনো কমিউনিটি সেন্টার বা মিলনায়তনের ভাড়া ৫০ হাজার টাকার বেশি হলে কিংবা ১০০ জনের বেশি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন হলেই রিটার্ন জমার অনুলিপি দেখানোর শর্ত প্রযোজ্য হতে পারে।

৪৩ সেবার মধ্যে অন্যতম হলো ২০ লাখ টাকার বেশি ঋণ আবেদন; ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কেনা; ক্রেডিট কার্ড নেওয়া; কোনো কোম্পানির পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডার হলে; ব্যবসায় সমিতির সদস্য হলে; কারও সন্তান বা পোষ্য ইংরেজিমাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করলে; অস্ত্রের লাইসেন্স নেওয়া; উপজেলা, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন ও জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হলে; চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ; ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ ও নবায়ন; সিটি করপোরেশন এলাকায় গ্যাস-বিদ্যুৎসহ সরকারি পরিষেবার সংযোগ নিতে হলে; ১০ লাখ টাকার বেশি মেয়াদি আমানত থাকলে; সরকারি কর্মচারীরা ১৬ হাজার টাকার বেশি মূল বেতন পেলে; নির্দিষ্ট ব্যক্তি কর্তৃক সিটি করপোরেশন এলাকায় বাড়িভাড়া বা লিজ গ্রহণের সময় বাড়ির মালিকের; নির্দিষ্ট ব্যক্তি কর্তৃক সেবা বা পণ্য গ্রহণকালে ওই পণ্য বা সেবা সরবরাহকারীর; ট্রাস্ট, তহবিল, ফাউন্ডেশন, এনজিও, ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী সংস্থা, সোসাইটি ও সমবায় সমিতির ব্যাংক হিসাব খুলতে ও চালু রাখতে; স্ট্যাম্প, কোর্ট ফি ও কার্টিজ পেপারে ভেন্ডার বা দলিল লেখক হিসেবে নিবন্ধন, লাইসেন্স বা তালিকাভুক্তি করতে বা বহাল রাখতে; রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা সরকার কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে এমন গঠিত কর্তৃপক্ষ বা অন্য সিটি করপোরেশন, পৌরসভায় অনুমোদনের জন্য ভবন নকশার আবেদন দাখিলকালে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *