ব্যবসা খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে করহারে ছাড় বা নীতিগত কোনো পরিবর্তন হবে কিনা, সে বিষয়ে এখনো কোনো ঘোষণা দেয়নি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।বিগত সরকারের পাস করা বাজেট ও করহার বহাল রাখা হবে নাকি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য নতুন রাজস্বনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবে, সে বিষয়ে এখনো অনিশ্চয়তার মধ্য রয়েছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা। গত ১৪ আগস্ট এনবিআরে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয়েছে।এ অবস্থায় এনবিআর-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের উচ্চ মহলের নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছেন তারা।
দীর্ঘদিন ধরেই রাজস্বনীতি ও কর কাঠামোয় পরিবর্তনের দাবি তুলে আসছেন ব্যবসায়ীরা। এটিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশের অন্তরায় বলে অভিযোগ তুলছেন তারা। একই সঙ্গে আমদানি-রফতানিতে শুল্কায়ন প্রক্রিয়ায় হয়রানি বন্ধেরও দাবি তুলছেন তারা।
ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা জানান, আয়কর বিভাগ অগ্রিম কর (এআইটি) হিসেবে ১ শতাংশ কর কাটে। এটিই ফাইনাল সেটেলমেন্ট। পরে আর আর কোনো দাবি-দাওয়া করা যায় না।এটি সমন্বয় বা রিটার্ন করার কথা। কিন্তু সেটা করা হচ্ছে না। যদি ফাইনাল সেটেলমেন্ট না করা হয়, তাহলে অগ্রিম কর নেয়া বন্ধ করতে হবে। করপোরেট কর ১২ শতাংশ কাটা হয়। কিন্তু রিটার্ন দাখিলের সময় এনবিআর কোনো আয় গ্রহণ না করলে তার ওপর আবার কর ধরে ৩০ শতাংশ। যদি না মানেন সেখানেও ১২ শতাংশই কাটুক। এফডিআরের লাভের ওপর কর কাটা হয় ২৮ শতাংশ। এর মধ্যে ব্যাংক উৎসে কর হিসেবে কেটে রাখে ১০ শতাংশ। আর রিটার্ন দাখিলের সময় কাটা হয় ১৮ শতাংশ। এফডিআরের লাভের ওপর ১২ শতাংশ কাটা হোক। অগ্রিম ও করপোরেট কর কাটার পর এ এফডিআর ব্যাংকে জমা হয়। ভ্যাট খাতে দেশের ভেতরে সুতা, অ্যাকসেসরিজ ও পণ্য মুভমেন্টের সময় মূসক চালান বাধ্যতামূলক। এটা হয়রানির একটা মাধ্যম। এটার বিধান রাখার প্রয়োজন নেই। যেকোনো মেশিনারিজ বা কোনো কিছু আমদানির ক্ষেত্রে ভ্যাট বিভাগ থেকে প্রত্যয়নপত্র নিতে হয়। এটিও হয়রানি। খরচের একটি খাত। এ প্রত্যয়নপত্র নেয়ার বিধান বাতিল করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যসোসিয়েশনের নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘প্রতি মাসে ভ্যাটের রিটার্ন দাখিলের বিধান বাতিল করতে হবে। কারণ আমরা বন্ডেও রিটার্ন দাখিল করি। কাস্টমস খাতে এইচএস কোডের প্রথম চারটি ডিজিট সঠিক থাকলে সেটাকেই গ্রহণ করতে হবে। এটিকে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে হয়রানি করা যাবে না। ওজনের সামান্য ক্রটি দেখিয়ে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে হয়রানি করা যাবে না। চারশ শতাংশ পর্যন্ত জরিমানার বিধান বাতিল করতে হবে। সংশোধনের সুযোগ দিতে হবে। নয়তো এ বিধানই বাতিল করা হোক। জরিমানা থেকে কর্মকর্তাদের প্রণোদনা দেয়ার বিধানও বাতিল করতে হবে। এক ডলারের নিচের মূল্যের পণ্য রফতানিতে হয়রানি বন্ধ করতে হবে। এক ডলারের কম দামের পণ্য রফতানি করা যাবে না, এ বিধান কোথাও নেই। এ বিধান বাতিল করতে হবে। শিপিং বিলের সিপিসি কোড নির্দিষ্ট করে দিতে হবে।’
এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে নীতিগত কোনো পরিবর্তন আসছে কিনা, করহারে আরো ছাড় দেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে এনবিআরের একজন সদস্য বলেন,‘এ বিষয়ে এখনই মন্তব্য করা যাচ্ছে না। সরকারের উচ্চ মহল থেকে নির্দেশনা কিছু আসার পরই বলা যাবে। সবকিছু স্বাভাবিক হোক। বাজেট প্রণয়ন ও পাসের সময় এক ধরনের সরকার ছিল আর এখন ভিন্ন ধরনের সরকার। আমরা চাই, যারা জেনুইন ব্যবসা করেন, তাদের জন্য কোনো উদ্যোগ নেয়া যায় কিনা। আসলে সিস্টেমটাই তো ছিল স্বৈরাচারী। অলিগার্ককে সাহায্য করা আর সাধারণ মানুষের মধ্যে বৈষম্য করাই ছিল। যদি কোনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করা যায় করব।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক সদস্য (শুল্ক ও মূসক) মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘বর্তমান কর সিস্টেম বৈষম্যে ভরা। ৮০ শতাংশ কর আয় আসে পরোক্ষ কর থেকে। আয়কর খাতের উৎসে করও পরোক্ষ কর। কর বেশি দেয়ার কথা ধনীদের, যাদের আয় বেশি। কিন্তু করের বোঝা যাচ্ছে সাধারণ মানুষের ওপর, গরিবের ওপর। খুচরা মূল্যের ওপর কর বসছে। আমরা দীর্ঘদিন বলে আসছি, কর ব্যবস্থায় সংস্কার করা দরকার। যত ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান, তার ওপর ভ্যাট বেশি। যত বড় প্রতিষ্ঠান, তত ভ্যাট কম। উৎসে ভ্যাট কর্তন আন্তর্জাতিক নিয়মের পরিপন্থী। ভ্যাটের মাল্টিপল রেট থাকলে সেটাকে ভ্যাট বলে না। এ ভ্যাট সিস্টেম অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির পরিপন্থী। এগুলো জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার করা দরকার। সমাজে বৈষম্য দূর করা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে গেলে রাজস্ব বোর্ডের সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। এটির সংস্কারেই দেশ উপকৃত হবে সবচেয়ে বেশি।’
এনবিআরের সাবেক সদস্য (কর জরিপ ও পরিদর্শন) রঞ্জন কুমার ভৌমিক বলেন, ‘এবারের বাজেটে দুই অর্থবছরের করহার প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের করহার ভালো। যদিও ব্যক্তি খাতে তেমন সুখবর নেই। কোম্পানির করহার ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমানো হয়েছে। তবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ধনীদের করহার বাড়বে।’
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আগে স্থিতিশীল হোক। তারপর সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে একটু রিভিউ করুক। বাজেট যা হওয়ার হয়ে গেছে। তিন মাসের অগ্রগতির মিটিং করেও এটা ঠিকঠাক করে নিতে পারবে। কোনো পরিবর্তন করতে চাইলে রাষ্ট্রপতি থেকে অনুমোদন নিয়ে নেবে উপদেষ্টা পরিষদ। সংসদে যেতে হলো না। মেজর কোনো পরিবর্তন করার দরকার পড়ছে না।’
তথ্য সূত্র: বণিক বার্তা