প্রতিবছর বাজেট আসে এবং মোটামুটি সবার আশায় গুড়ে বালি পড়ে। এটা মোটামুটি সব বছরেই সবাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। বিগত ফ্যাসিস্ট রেজিম চলে যাওয়ার পর সবাই আশা করেছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য একটা যুগোপযোগী বাজেট হবে। কিন্তু সেই গণ্ডি থেকে এবারও বের হতে পারল না সরকার। ফলাফল প্রতিবছরের ন্যায় এবারও আমাদের বেতন কমছে।
এই কমা হচ্ছে দুই ভাবে ১. ট্যাক্সের চাপ, ২. মুদ্রাস্ফীতি। আর এটা করতে হচ্ছে সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় যা বেশির ভাগই সরকারি কর্মচারীদের বেতন–ভাতা, পেনশন এবং তাদের নিজেদের অক্ষমতার জন্য কর আদায় কম হওয়ার ঘাটতি মেটাতেই। এখন দেখি কীভাবে কমছে
আয়কর স্ল্যাব পরিবর্তন
আমাদের সরকারের সবচেয়ে সহজ আদায়যোগ্য কর হচ্ছে ব্যাক্তিগত আয়কর। কারণ, সবার বেতন ব্যাংকে যায়, অফিস থেকেই ট্যাক্স কেটে রাখে, এমনকি কারও বেতন ১৫ হাজার টাকা হলেও টিন খোলার বাধ্যবাধকতা আছে এবং অফিসগুলোতে ট্যাক্স রিটার্নের কাগজও জমা দিতে হয়। ফলে এনবিআর মোটামুটি বিনা পরিশ্রমেই ট্যাক্স পেয়ে যায়। এখন টিন খোলা মানে আপনার ট্যাক্স হোক না হোক আপনাকে ৫ হাজার টাকা দিতে হবেই। নতুন খুললেও ১ হাজার।
এখন এই বাজেটে ২০২৬-২৭ এর জন্য নতুন আয়কর প্রস্তাব করা হয়েছে। এবং এখানেই আপত্তি। এখন দেখে নিই বর্তমান আয়করের সঙ্গে প্রস্তাবিত আয়করের কী পার্থক্য।
২০২৪-২৫ সালের বর্তমান কাঠামো অনুসারে প্রথম ৩,৫০,০০০ পর্যন্ত ০ শতাংশ, পরবর্তী ১,০০,০০০ পর্যন্ত ৫ শতাংশ, পরবর্তী ৪,০০,০০০ পর্যন্ত ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৫,০০,০০০ পর্যন্ত ১৫ শতাংশ, পরবর্তী ৫,০০,০০০ পর্যন্ত ২০ শতাংশ, পরবর্তী ২০,০০,০০০ পর্যন্ত ২৫ শতাংশ, ৩৮,৫০,০০০ টাকার ঊর্ধ্বে ৩০ শতাংশ।
প্রস্তাবিত ২০২৬-২৭ সালে আছে প্রথম ৩,৭৫,০০০ পর্যন্ত ০ শতাংশ ,পরবর্তী ৩,০০,০০০ পর্যন্ত ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৪,০০,০০০ পর্যন্ত ১৫ শতাংশ, পরবর্তী ৫,০০,০০০ পর্যন্ত ২০ শতাংশ, পরবর্তী ২০,০০,০০০ পর্যন্ত ২৫ শতাংশ, ৩৮,৫০,০০০ টাকার ঊর্ধ্বে ৩০ শতাংশ।
করযোগ্য আয় (টাকা) | বর্তমান করহার (২০২৪–২৫) | প্রস্তাবিত করহার (২০২৬–২৭) |
---|---|---|
প্রথম ৩,৫০,০০০ পর্যন্ত | ০% | ✳️ ৩,৭৫,০০০ পর্যন্ত – ০% |
পরবর্তী ১,০০,০০০ পর্যন্ত | ৫% | ✳️ পরবর্তী ৩,০০,০০০ পর্যন্ত – ১০% |
পরবর্তী ৪,০০,০০০ পর্যন্ত | ১০% | ✳️ পরবর্তী ৪,০০,০০০ পর্যন্ত – ১৫% |
পরবর্তী ৫,০০,০০০ পর্যন্ত | ১৫% | অপরিবর্তিত – ২০% |
পরবর্তী ৫,০০,০০০ পর্যন্ত | ২০% | অপরিবর্তিত – ২০% |
পরবর্তী ২০,০০,০০০ পর্যন্ত | ২৫% | অপরিবর্তিত – ২৫% |
৩৮,৫০,০০০ টাকার ঊর্ধ্বে | ৩০% | অপরিবর্তিত – ৩০% |
প্রথম অংশে ছাড় দিলেও (বাস্তবে ছাড় না, ৫০০০ টাকা তো দিতে হবেই) পরের সব ভাগেই তারা ১ লাখ টাকা করে কমিয়ে দিয়েছে। ফলাফল হবে সবার ওপরই বাড়তি চাপ বাড়বে। কেমন বাড়বে সেটা দেখি কারও বাৎসরিক করযোগ্য আয় (৫০ হাজার প্রতি মাসে) যদি হয়, তাঁর আয়কর বাড়বে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। এভাবে আসলে সবার ট্যাক্সই বাস্তবে বেড়ে গেল। মানে বেতন কমে গেল।
এ ছাড়া আর এক জায়গায় সরকার কমিয়েছে, সেটা হচ্ছে আগে বিনিয়োগ করে কর রেয়াত পাওয়া যেত। এখানেও সরকার মধ্যবিত্তদের ওপর হাত দিয়েছে। ২০১৯-২০ করবর্ষে রিবেটযোগ্য বিনিয়োগ সীমা ছিল করযোগ্য আয়ের ২০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা (যেটি কম), রিবেট হার (ছাড়ের হার) ছিল মোট রিবেটযোগ্য বিনিয়োগের ওপর ১৫ শতাংশ, যেখানে সর্বোচ্চ ছাড় পাওয়া যেত ৩ দশমিক ৭৫ লাখ টাকা।
২০২৪-২৫ করবর্ষে সেটা এখন রিবেটযোগ্য বিনিয়োগ সীমা করযোগ্য আয়ের ২০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ১ দশমিক ৫ কোটি টাকা (যেটি কম) রিবেট হার (ছাড়ের হার) বাৎসরিক আয় ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ১৫ শতাংশ এবং ১৫ লাখ টাকার ওপরে হলে ১০ শতাংশ।
২০২৬-২৭ করবর্ষে (প্রস্তাবিত) রিবেটযোগ্য বিনিয়োগ সীমা হবে করযোগ্য আয়ের ২০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ১ দশমিক ৫ কোটি টাকা (যেটি কম), যা আগের মতোই; কিন্তু পরিবর্তন এসেছে রিবেট হার (ছাড়ের হার) আয় ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ১৫ শতাংশ, ১০-২৬ লাখ টাকা পর্যন্ত ১২ শতাংশ এবং আয় ২৬ লাখ টাকার ওপরে গেলে ১০ শতাংশ।
সরকার বিনিয়োগও চাইবে আবার রিবেটে ছাড়ও কমিয়ে দেবে। এ রকম পরস্পরবিরোধী অবস্থান কেন? এই বুদ্ধি কার কাছ থেকে আসে?
মূল্যস্ফীতি
সাধারণ মানুষের ওপর এই চাপ কেন
এরপর আসে এনবিআরের অদক্ষতা। এই অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে তারা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৫৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ আদায় করতে পেরেছে। এনবিআর কখনোই তার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে না, এবার যেহেতু প্রায় ১ মাসের কলমবিরতি ছিল, এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব একেবারেই হবে না।
কিন্তু সরকার মুখে সবাইকে খরচ কমাতে বলেও প্রস্তাবিত বাজেটে খরচ বেতন–ভাতাতে গত বছরের থেকে ৩ হাজার কোটি এবং পেনশনেও খরচ বেড়েছে প্রায় ৩৬ শতাংশ। যেখানে অনেক দিন ধরেই প্রস্তাবনা ছিল এই খাতের খরচ ২০ শতাংশ কমানোর। যেহেতু এনবিআরের মানুষজন জানে কীভাবে নিজেদের (ব্যাপক অর্থে সরকারি কর্মচারীদের) ওপর চাপ না পড়ে, তাই সহজ সমাধান বেসরকারি খাতের মানুষের ওপর নতুন ট্যাক্সের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া। কেন বলছি, এই বোঝা কি শুধু বেসরকারি মানুষজনের ওপর? কারণ, সরকারি কর্মচারীদের ট্যাক্স শুধু বেসিকের ওপর হয়, বাকি সব ভাতা ট্যাক্স ফ্রি।
আয়কর দিয়ে বেসরকারি কর্মজীবীরা কিছুই পাচ্ছে না?
প্রস্তাব কী
২০১৯-২০ আয়কর বর্ষে ছিল আয়করমুক্ত সীমা ২ লাখ ৫০ হাজার, পরবর্তী ৪ লাখ ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লাখ ১৫ শতাংশ, পরবর্তী ৬ লাখ ২০ শতাংশ, পরবর্তী ৩০ লাখ ২৫ শতাংশ, এরপর ৩০ শতাংশ।
সেই হিসাবে নতুন প্রস্তাব: আয়করমুক্ত সীমা ৩ লাখ ৭৫ হাজার, পরবর্তী ১,০০,০০০ পর্যন্ত ৫ শতাংশ, পরবর্তী ৪ লাখ ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লাখ ১৫ শতাংশ, পরবর্তী ৬ লাখ ২০ শতাংশ, পরবর্তী ৩০ লাখ ২৫ শতাংশ, এরপর ৩০ শতাংশ। এ ছাড়া রিবেটের হার ২০১৯-২০ অর্থবছরের অনুরূপ করা উচিত। এবং ন্যূনতম কর ৫ হাজারের পরিবর্তে ৩ হাজার করা উচিত। এই হার যদি গ্রহণ করা হয় তাহলে একজন বার্ষিক ৬ লাখ টাকা আয় করা মানুষের কর কমবে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। মানুষের সঞ্চয় এবং বিনিয়োগও বাড়বে। যার সুফল পাবে সরকার।
এ ছাড়া দেশের টিন থাকা মানুষের মধ্যে মাত্র ৩৫ শতাংশ মানুষ ট্যাক্স দেয়। সহনীয় মাত্রায় ট্যাক্স ঠিক করলে তারাও দিতে উৎসাহী হবে। যদি তাদের অন্তত একটা সুবিধা দেওয়া যায়, দেশের শতভাগ মানুষই ট্যাক্স দেবে। এ ছাড়া যারা কর দেয় তাদের ওপর চাপ না বাড়িয়ে বরং এর আওতা বাড়ানো উচিত। যেহেতু এক দেশে দ্বৈত আইন থাকতে পারে না, সরকারি কর্মচারীদেরও একই আয়কর আইনের আওতায় নিয়ে আসা উচিত।
সরকার যদি এই প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করে সরকারের আয় না কমে বরং বাড়বে এবং অনেক মানুষকেই আইন মানতে উদ্বুদ্ধ করবে। বাংলাদেশের মানুষ সরকারকে সাহায্য করতে চায়, তার বড় প্রমাণ রেমিট্যান্স–যোদ্ধারা। এখন আয়কর আইন সহজ করে বাকিদেরও দায়িত্ব পালনের সুযোগ করে দেওয়ার দায়িত্বও সরকারের।
- সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কলামিস্ট